আমাদের অনেকের মনে এই প্রশ্নটা প্রায় আসে – তরুণরা কেন কম আক্রান্ত এবং বয়স্ক ব্যক্তিরা কেন আক্রান্ত বেশি। বিষয়টির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে যথেষ্ট। আমাদের সহজবোধ্য ধারণা বয়স্কদের শরীর দুর্বল এবং তাঁদের রোগ প্রতিরোধ-ক্ষমতাও দুর্বল। এ জন্যই তাঁদের ঝুঁকি বেশি। সেটা হয়তো কিছু অংশে ঠিক।

কিন্তু আসল কারণ হলো, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের শ্বাসতন্ত্রে এইস–২ রিসেপ্টারের ঘনত্ব বেড়ে যায়। সে জন্যই তরুণদের তুলনায় বয়স্করা সহজে আক্রান্ত হন। শুধু তা–ই নয়, পুরুষদের তুলনায় নারীদের দেহে এইস–২ রিসেপ্টারের ঘনত্ব কম। সে জন্যই কোভিড–১৯ ভাইরাসে নারীরাও তুলনামূলক কম আক্রান্ত হন।

গবেষণায় জানা যায় কোভিড–১৯ প্রধানত শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়ায়। কোভিডে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাস ছাড়ার সময় বা হাঁচি–কাশির সময় অসংখ্য ড্রপলেটের মাধ্যমে কোভিড–১৯ ভাইরাসটি কিছুক্ষণ বাতাসে ভেসে থাকে। এই ভাইরাস একটি আরএনএ ভাইরাস, যার চারপাশে থাকে লিপিডের (একধরনের চর্বি) আবরণ ও কাঁটার মতো স্পাইক গ্লাইকো প্রোটিন। অন্যদিকে মানুষের কোনও কোনও কোষে থাকে এইস–২ (ACE2) রিসেপ্টার। দেহকোষে এই রিসেপ্টারের ঘনত্ব বেশি থাকলে আক্রান্ত হওয়ার বিপদ বেশি, কম থাকলে কম।

প্রধানত শ্বাসতন্ত্র কেন আক্রান্ত হয়;

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রক্রিয়াটি হলো এ রকম—এইস–২ রিসেপ্টারগুলোকে ভাইরাসের স্পাইক আঁকড়ে ধরে কোষের ভেতর ঢুকে পড়ে এবং কোষের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এরপর কোষের নিজস্ব কার্যপদ্ধতি ব্যবহার করে ভাইরাস তার লাখ লাখ অনুলিপি তৈরি করতে থাকে। কিন্তু কোষের ভেতরে ঢুকে পড়ার জন্য এইস–২–এর সঙ্গে বিশেষ ধরনের এনজাইম থাকতে হয়। কোভিড–১৯ ভাইরাস মানবদেহের সব ধরনের কোষ আক্রান্ত করতে পারে না। তবে শ্বাসতন্ত্রের কোষগুলোকে সহজেই কাবু করে ফেলে। সে জন্যই কোভিড–১৯ প্রধানত শ্বাসতন্ত্রকে ঘায়েল করে।

অনেকে লক্ষণ বিহীন থাকেন কেন?

আমরা কোনও ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হলে দেহের রোগ প্রতিরোধ-ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং বহিরাগত শত্রুকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য ওই নির্দিষ্ট ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার অ্যান্টিবডি তৈরি করে। কেউ যদি এর আগে একই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে বেশ কিছু সময় পর্যন্ত অনেকের দেহে আগে থেকেই ওই নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি থাকে এবং সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। অথবা টিকা নেওয়ার পর অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। অ্যান্টিবডি সক্রিয় হয়ে ওঠার অর্থই হলো শরীরের জন্য ক্ষতিকর রোগজীবাণু ঢুকে পড়েছে। জীবনের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। এই সংকেত পেলেই শরীরে কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। এ জন্যই অনেক সময় আমরা বলি, জ্বর হলো অসুস্থতার উপসর্গ-মাত্র, আসল কারণ দেহে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ।

করোনায় আক্রান্ত হলেও একইভাবে কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন সামান্য জ্বর, শুকনা কাশি, গলা ব্যথা ইত্যাদি। তবে অনেক সময় কেউ কোভিড–১৯–এ আক্রান্ত হলেও কোনও উপসর্গ দেখা যায় না। কিন্তু তাদের শ্বাসপ্রশ্বাস ও হাঁচি–কাশি থেকে অন্যদের মধ্যে করোনার সংক্রমণ ঘটতে থাকে। উপসর্গের বহিঃপ্রকাশ না থাকার একটি কারণ হতে পারে এই যে কারও কারও দেহে করোনার সংক্রমণ ঘটলেও কোনও কারণে শরীর কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায় না। ফলে বোঝাই মুশকিল হয়ে ওঠে যে তার কোভিড সংক্রমণ ঘটেছে। এটাই উপসর্গ-বিহীন কোভিড। রোগের কোনও উপসর্গ দেখা যায় না। ইংরেজিতে একে বলা হয় অ্যাসিম্পটোমেটিক কোভিড। এর আরেকটি কারণ হতে পারে, তাদের ভাইরাস সংক্রমণ যথেষ্ট গুরুতর নয় বা তাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া এত তীব্র নয় যে রোগের লক্ষণ শরীরে দেখা দেবে।

মূলত যাদের শরীরে ভাইরাল লোডিং কম থাকে তাদের লক্ষণ বিহীন করোনা দেখা দেয়। যাদের এইস ২ রিসেপ্টর এর ঘনত্ব কম তাদের করোনা ভাইরাস এর সংক্রমণও কম হয়। কিন্তু সব তরুণদের এই এইস ২ রিসেপ্টর এর ঘনত্ব একই না থাকতে পারে। তাই তাদের সচেতন থাকতে হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবন জীবিকা পালন করতে হবে। কেননা তরুণ তরুণীরা আক্রান্ত না হলেও তাদের শরীরে করোনা ভাইরাসের যে লক্ষণ বিহীন জীবাণু থাকে তাতে পরিবারের অন্যান্য সিনিয়র বয়স্ক মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে।

তাই তরুণরা কম আক্রান্ত হলেও তারাও কিন্তু পরিবার ও সমাজের জন্য ঝুঁকির কারণ। নিজেরা করোনা আক্রান্ত থেকে মুক্ত রাখতেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। তরুণ বলে কোভিড ১৯ হবে না এটা ভেবে অলিতে গলিতে বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজি করা ঠিক হবে না।এর পরেও আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। নিজেদের সতর্ক রাখতে হবে এবং সচেতন করার কাজে তারুণ্য শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে।

করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে তরুণদের ভূমিকা রয়েছে আরও জোরালো। কারণ তরুণদের সাহসী ভূমিকা এলাকা ভিত্তিক স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরিতে কাজ করতে পারে। নিজেদের সংগঠিত করে এলাকার বিত্তশালীদের সহযোগিতায় মাস্ক ও স্যানিটাইজ বিতরণ করতে পারে।

এভাবেই সম্মিলিতভাবে সবাই মিলে করোনা প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসতে হবে।

Leave a Reply